বাংলাদেশে জমি কেনাবেচা বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তির পর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খারিজ করা। খারিজ আসলে সরকারের নিকট জমির মালিকানা হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। অনেকেই মনে করেন, রেজিস্ট্রি করলেই জমির মালিক হয়ে গেলেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, খারিজ ছাড়া মালিকানা আইনগতভাবে সুরক্ষিত থাকে না। ফলে ভবিষ্যতে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।
খারিজ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো বাতিল বা প্রতিস্থাপন। জমির ক্ষেত্রে খারিজ মানে হলো – পুরনো মালিকের নাম রেকর্ড থেকে মুছে নতুন মালিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা।
আইনগত সংজ্ঞা: খারিজ হলো ভূমি রেকর্ড সংশোধন বা হালনাগাদ প্রক্রিয়া, যা সরকারী নথিতে নতুন মালিককে স্বীকৃতি দেয়।
রেকর্ড ও মালিকানা: রেজিস্ট্রি কেবল মালিকানা প্রমাণের প্রথম ধাপ, কিন্তু খারিজ ছাড়া জমির রেকর্ডে এখনো পুরনো মালিকের নামই থাকবে।
বাংলাদেশে জমি খারিজের আইনি ভিত্তি হলো ভূমি রেকর্ড ও জরিপ আইন। রেজিস্ট্রির মাধ্যমে চুক্তি সম্পন্ন হলেও, জমির প্রকৃত দখল ও রেকর্ড হালনাগাদ হয় কেবল খারিজের মাধ্যমে।
রেজিস্ট্রি বনাম খারিজ: রেজিস্ট্রি জমি হস্তান্তরের চুক্তি প্রমাণ করে, আর খারিজ জমি রেকর্ডে মালিকানা নিশ্চিত করে।
খারিজ না করলে জমির মালিকানা নিয়ে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে:
আইনগত জটিলতা: আদালতে জমি সংক্রান্ত মামলায় খারিজ ছাড়া মালিকানা প্রমাণ করা কঠিন।
দ্বন্দ্ব: পুরনো মালিক বা তার উত্তরাধিকারীরা মালিকানা দাবি করতে পারেন।
কর সমস্যা: খারিজ না হলে নতুন মালিকের নামে খাজনা দিতে সমস্যা হয়।
এখানেই মূল প্রশ্ন। আসলে, খারিজ না করলে জমির রেকর্ডে পূর্ববর্তী মালিকের নামই থাকবে। ফলে আইনগত দিক থেকে জমির প্রকৃত মালিক হিসেবে তাকে ধরা হবে।
উত্তরাধিকারীর অধিকার: যদি পুরনো মালিক মারা যান এবং খারিজ না করা থাকে, তবে তার উত্তরাধিকারীরাই মালিক হবেন।
নতুন মালিকের সমস্যা: আপনি টাকা দিয়ে জমি কিনলেও, খারিজ না করলে আইনগতভাবে আপনার মালিকানা অস্বীকৃত থাকবে।
আদালতের ভূমিকা: কোনো বিরোধ হলে আদালত খারিজকে প্রধান প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করে মালিক নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশে খারিজ না করার কারণে অগণিত পরিবার ও ব্যক্তি সমস্যায় পড়েছেন। উদাহরণস্বরূপ:
পারিবারিক জমি: একজন বাবা তার সন্তানদের জন্য জমি রেখে গেছেন, কিন্তু খারিজ করা হয়নি। কয়েক বছর পর উত্তরাধিকারীরা জমি ভাগাভাগি করতে গিয়ে দেখে, সরকারি রেকর্ডে এখনো বাবার নাম রয়েছে। এতে মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলা শুরু হয়।
কেনাবেচার পর সমস্যা: অনেক ক্রেতা জমি কিনে রেজিস্ট্রি করলেও খারিজ করেন না। পরে অন্য কেউ একই জমি কিনে খারিজ করলে প্রকৃত মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
খারিজ করার জন্য কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হয়:
আবেদন জমা: স্থানীয় ভূমি অফিসে খারিজের জন্য আবেদন করতে হয়।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
দলিলের কপি
রেকর্ড অব রাইটস (ROR)
খাজনার রশিদ
আবেদনকারীর পরিচয়পত্র
সময়সীমা ও খরচ: সাধারণত খারিজ প্রক্রিয়া কয়েক মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়। খরচ জমির ধরন ও এলাকার উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে।
যদি খারিজ না করা হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মালিকানা প্রমাণ করতে সমস্যায় পড়বে। এতে জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব, মামলা এবং এমনকি জমি হারানোর মতো পরিস্থিতিও হতে পারে।
অনেকে মনে করেন, রেজিস্ট্রি করলেই যথেষ্ট।
কেউ কেউ ভাবেন খাজনা দিলেই মালিকানা প্রমাণ হয়ে যায়।
আবার অনেকে মনে করেন খারিজ করা ঝামেলার কাজ।
কিন্তু আসল সত্য হলো, খারিজ ছাড়া জমির মালিকানা আইনগতভাবে সুরক্ষিত নয়।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, রেজিস্ট্রি হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব খারিজ করতে হয়। কারণ রেকর্ডে পরিবর্তন না হলে সরকার আপনাকে মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না।
খারিজ সম্পন্ন হলে নতুন মালিকের নামে খাজনা বা ভূমি কর জমা দেওয়া হয়। এতে সরকারিভাবে মালিকানা আরও শক্তিশালী হয়।
সব কাগজপত্র সঠিকভাবে সংগ্রহ করুন।
আবেদন করার পর নিয়মিত ভূমি অফিসে যোগাযোগ রাখুন।
প্রয়োজনে আইনজীবীর পরামর্শ নিন।
ভূমি বিশেষজ্ঞদের মতে, জমি কেনার পর রেজিস্ট্রির সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এতে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়তে হয় না।
রেজিস্ট্রি করেও খারিজ না করা → সমাধান: যত দ্রুত সম্ভব খারিজ করুন।
ভুল কাগজপত্র জমা দেওয়া → সমাধান: প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র যাচাই করে জমা দিন।
মামলা-মোকদ্দমায় দেরি করা → সমাধান: আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুত পদক্ষেপ নিন।
খারিজ কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং জমির প্রকৃত মালিকানা প্রমাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। খারিজ না করলে জমির মালিকানা পুরনো মালিক বা তার উত্তরাধিকারীর কাছেই থেকে যায়। ফলে নতুন মালিক হিসেবে আপনার অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। তাই জমি কেনাবেচা বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তির পর রেজিস্ট্রির পাশাপাশি খারিজ করাও জরুরি।
মনে রাখবেন: রেজিস্ট্রি ছাড়া জমির মালিকানা প্রমাণ হয় না, আর খারিজ ছাড়া জমির মালিকানা স্বীকৃতি পায় না।