বাংলাদেশে জমি কেনা শুধু আর্থিক বিনিয়োগ নয়, এটি একজন মানুষের জীবনের অন্যতম বড় সিদ্ধান্ত। অনেকেই সারা জীবনের সঞ্চয় খাটিয়ে একটি জমি কিনতে চান। কিন্তু জমি কেনার আগে মালিকানা চেইন যাচাই না করলে নানা ধরনের জটিলতা, প্রতারণা এবং আইনি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব বা পুরনো মামলা জমির স্বত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই সচেতনভাবে সব যাচাই-বাছাই করাই নিরাপদ বিনিয়োগের প্রথম ধাপ।
মালিকানা চেইন বলতে বোঝায় একটি জমির মালিকানা শুরু থেকে বর্তমান মালিক পর্যন্ত যেসব হাতবদল হয়েছে তার ধারাবাহিক রেকর্ড। সহজভাবে বললে, এই চেইন প্রমাণ করে জমিটির বৈধ মালিকানা কার হাতে আছে এবং পূর্বের মালিকানা ঠিকভাবে হস্তান্তর হয়েছে কি না।
একটি জমির মালিকানা চেইন পরিষ্কার থাকলে ক্রেতা নিশ্চিত হতে পারেন যে জমিটি নিয়ে কোনো আইনি জটিলতা নেই। এটি কেবল জমি কেনার সময় নয়, ভবিষ্যতে জমি বিক্রি বা বন্ধক রাখার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে ভূমি সংক্রান্ত প্রতারণার অন্যতম বড় মাধ্যম হলো জাল দলিল তৈরি করা। যদি জমির মালিকানা চেইন যাচাই না করা হয়, তাহলে জাল দলিল দিয়ে জমি বিক্রির ঘটনা ঘটতে পারে।
একই জমি একাধিক মালিক দাবি করলে আদালতে মামলা গড়ায়। এতে জমি কেনার পরও ক্রেতা দখল বা ব্যবহার করতে পারেন না।
মালিকানা চেইন পরিষ্কার না থাকলে জমির উপর দখলদারিত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। এতে দীর্ঘমেয়াদি মামলা মোকদ্দমার সম্মুখীন হতে হয়।
কিছু জমি সরকারের অধিগ্রহণ তালিকায় থাকতে পারে বা খাস জমি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। মালিকানা চেইন যাচাই না করলে এই ধরনের জমি কিনে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।
বাংলাদেশে জমি ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়াটি মূলত রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮ এবং ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। প্রতিটি জমির স্বত্ব দলিল রেজিস্ট্রি অফিসে নথিভুক্ত করা থাকে। দলিল রেজিস্ট্রেশন না করলে তা আইনি বৈধতা পায় না। তাই জমি কেনার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে বিক্রেতার দলিল যথাযথভাবে রেজিস্ট্রার্ড।
খতিয়ান হলো জমির মূল রেকর্ড, যেখানে মালিকের নাম, জমির পরিমাণ, দাগ নম্বর ও মৌজা উল্লেখ থাকে। নামজারি প্রমাণ করে জমির হালনাগাদ মালিক কে। দলিল কেবল জমির মালিকানা হস্তান্তরের আইনি প্রমাণ। এই তিনটির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকলে জমির মালিকানা নিয়ে সন্দেহ থাকে না।
প্রথম ধাপে বিক্রেতার দলিল রেজিস্ট্রেশন কার্যালয় থেকে সত্যায়িত করে নিতে হবে। অনেক সময় জাল দলিল তৈরি হয়, যা অফিস থেকে যাচাই করলে ধরা পড়ে।
খতিয়ান হলো মূল প্রমাণ। এসএ (সার্ভে), আরএস (রিভিশন সার্ভে) ও বিএস (বর্তমান সার্ভে) পর্চা দেখে জমির মালিকানা চেইন মিলিয়ে নিতে হবে।
উপজেলা ভূমি অফিসে জমি সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়। সেখান থেকে জানা যাবে জমিটি সরকারের অধিগ্রহণের তালিকায় আছে কিনা, অথবা খাস জমি হিসেবে ঘোষিত কি না।
একজন দক্ষ আইনজীবী বা ভূমি বিশেষজ্ঞ সব নথি মিলিয়ে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন। এতে প্রতারণার আশঙ্কা কমে যায়।
বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে অনলাইনে ভূমি সেবা চালু করেছে। land.gov.bd পোর্টাল থেকে খতিয়ান, পর্চা ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
ডিজিটাল রেকর্ডের কারণে ভবিষ্যতে দলিল জালিয়াতি কমে আসবে এবং মালিকানা যাচাই আরও সহজ হবে।
মোঃ করিম একজন Italy প্রবাসী। বহু বছর বিদেশে থেকে সঞ্চয় করে তিনি ঢাকার উপকণ্ঠে একটি জমি কিনলেন। জমিটি তিনি কিনেছিলেন এক আত্মীয়ের মাধ্যমে এবং তাড়াহুড়ো করে শুধুমাত্র দলিল দেখে টাকা পরিশোধ করেন। করিম ভেবেছিলেন যেহেতু আত্মীয়ের মাধ্যমে কেনা হচ্ছে, তাই বাড়তি যাচাইয়ের দরকার নেই।
কিন্তু কিছুদিন পর করিম জমিতে বাড়ি করতে গেলে দেখা যায় জমির উপর ইতিমধ্যেই অন্য একজন দখল করে রেখেছেন। তিনি দাবি করেন যে জমিটি তার বাবা বহু বছর আগে কিনেছিলেন এবং জমির খতিয়ান ও নামজারি তার নামে আছে।
করিম তখন বুঝতে পারেন যে তিনি শুধুমাত্র দলিল দেখে জমি কিনেছেন, কিন্তু খতিয়ান ও নামজারি যাচাই করেননি। পরবর্তীতে জানা যায়, বিক্রেতা আসল মালিক নন, বরং ভুয়া দলিল ব্যবহার করে প্রতারণা করেছেন। করিমের পরিবার মামলা করলেও দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় পড়ে যান এবং জমি হাতে পাননি।
জমি কেনার সময় সব ধরনের চুক্তি লিখিতভাবে করতে হবে এবং নোটারাইজড দলিল করতে হবে।
নামজারি সম্পন্ন না করলে জমির প্রকৃত মালিকানা প্রমাণ হয় না। তাই ক্রয়ের পর দ্রুত নামজারি করতে হবে।
অনেক জমি ব্যাংকে বন্ধক রাখা থাকে। তাই ব্যাংক ঋণের অবস্থা যাচাই না করলে নতুন ক্রেতা ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
সব নথি যাচাই করলে জমি কেনা অনেক নিরাপদ হয় এবং প্রতারণার আশঙ্কা কমে যায়।
জমি একটি দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ। পরিষ্কার মালিকানা থাকলে ভবিষ্যতে বিক্রি বা বন্ধক রাখা সহজ হয়।
মালিকানা নিয়ে বিরোধ না থাকলে পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিন্তে জমি ব্যবহার করতে পারেন।
বিদেশে জমি কেনার ক্ষেত্রে আইন আরও কঠোর। সেখানে জমির প্রতিটি দলিল ও ট্যাক্স রেকর্ড সরকারি ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা না থাকলেও ধীরে ধীরে ডিজিটাল রূপান্তর ঘটছে।
অনেকে মনে করেন দলিল হাতে পেলেই জমির মালিকানা নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাস্তবে দলিল, খতিয়ান ও নামজারি – তিনটি মিলে তবেই মালিকানা সম্পূর্ণ হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন আত্মীয় বা পরিচিত জনের কাছ থেকে জমি কিনলে যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই, যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
জমি কেনার আগে অবশ্যই অভিজ্ঞ আইনজীবী বা ভূমি বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা উচিত। এতে প্রতারণার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
জমি কেনার আগে মালিকানা চেইন যাচাই করা শুধু একটি প্রক্রিয়া নয়, এটি নিরাপদ বিনিয়োগের মূল ভিত্তি। প্রতারণা, মামলা বা আর্থিক ক্ষতি এড়াতে ক্রেতাকে অবশ্যই দলিল, খতিয়ান, নামজারি এবং ব্যাংক রেকর্ড যাচাই করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার ও আইনগত সহায়তা নিয়ে যদি ক্রেতা এগোন, তবে জমি কেনা হবে নির্ভরযোগ্য এবং ঝুঁকিমুক্ত।